top of page

Bagha Jatin (Bangla Version)

The Bengali version is a translation of the English version with guidance and input from Sri Prithwindra Mukherjee, Padmashree, grandson of Bagha Jatin, a great and worthy scholar in French and English, who has written several works, including Life and Times of Bagha Jatin, and has contributed immensely toward Info-French cultural bonding.  We express our deep reverance and gratitude to the great scholar for his help, active and untiring support, and endeavour for bringing to light the immense contribution of Bagha Jatin to the Indian freedom movement. 

   বাঘা যতীন - ভারতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় 
-শান্তনু দে ও পৃথ্বী
ন্দ্রনাথ মুখার্জী
 
Chapter 2

“ওই মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে মর্ত্য  ভূমির ঘাসে ঘাসে”


যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ৭-ই ডিসেম্বর, ১৮৭৯ সালে শরৎশশী দেবী ও উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যার ঘরে জন্ম নেন। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে তাঁর মামার বাড়ি নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া পরগনার অন্তর্গত এবং অধুনা বাংলাদেশের কয়াগ্রামে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশে যশোহর জেলার ঝিনাইদহের অন্তর্গত সাধুহাটি-ঋষিখালি গ্রামে। তাঁর বড়দিদি ছিলেন বিনোদবালা। ছোটভাই সুরেন্দ্রনাথ অল্পবয়সে মারা যান। উমেশচন্দ্র ছিলেন সৎ, সত্যবাদী, এবং ধার্মিক ব্রাহ্মণ। তিনি ঘোড়ায়  চড়তে ভালোবাসতেন। নীলকরদের অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তাঁদের সেরেস্তায় চাকরি স্বীকার করেননি। অত্যধিক সৎ হওয়ার ফলে তিনি বিষয় আশয়ের দিকে মনোযোগ দেননি। যতীন্দ্র যখন পাঁচ বছর বয়সের শিশু তখন উমেশচন্দ্রের মৃত্যু হয়। এরপর যতীন তাঁর মামাবাড়ি কয়াগ্রামে মামা বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে মানুষ হতে থাকেন।

 

তাঁর মা শরৎশশী দেবীর কাছে যতীন্দ্র রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদির মধ্যে দিয়ে তাঁর শিক্ষা লাভ করেন। সেই হিন্দু শাস্ত্রাদির মধ্যে সাহস, আত্মমর্যাদা, ও আত্মবলিদানের কাহিনীগুলির শিক্ষা তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়। পরবর্তীকালে সেই শিক্ষার অনুরণন আমরা তাঁর জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখেছি। নিদারুণ আঘাত তাঁকে বিচলিত করেনি। অমানবিক কষ্ট ও সন্তান শোক তিনি সহ্য করেছেন। দেহযন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি দেশ ও জাতিকে শিখিয়েছেন কিভাবে লড়াই করতে হয়, কিভাবে হিংস্র শত্রুর মোকাবিলা করে তাদের মরণ আঘাত হানতে হয়। তিনি আত্মবিসর্জন দিয়ে আত্মমহিমা ঘোষণা করে গেছেন। যাঁরা বড়ো, যাঁরা মহান, তাঁদের মা বাবাও মহৎ হন। উমেশচন্দ্রের কথা আগেই আলোচনা করেছি। শরৎশশী দেবী যতীন্দ্রর চরিত্র গঠনে এক বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন । তিনি নিজেই ছিলেন এক আদর্শ নারী। তিনি গ্রামের সমস্ত মানুষকে তাদের বিপদে আপদে সাহায্য করতেন, তাদের অসুখ বিসুখে সেবা করতেন, এবং নিজেদের আর্থিক অবস্থ ভালো না হলেও সাধ্যমতো সবাইকে সাহায্য করতেন, এরকমই প্রশস্ত ছিল তাঁর হৃদয়। তিনি ছিলেন কবি, ভক্তিময়ী, বিদুষী। তাঁর বেদনাবিধুর জীবন কাব্য তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন। তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরীতে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রায় সমস্ত দিকপাল লেখকের রচনা ছিল। তাঁর গুণাবলীর প্রকৃত উত্তরাধিকারী ছিলেন তাঁর সন্তানেরা। বিনোদবালাও ছিলেন বিদুষী এবং কবি। শরৎশশীর ছোটো ছেলে সুরেন্দ্রর নাম পারিবারিক বন্ধু সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে দেওয়া হয়েছিল। সুরেন্দ্র অল্পবয়সে মারা যান। কলেরা রুগীর সেবা করবার পরিণতিতে সেই অসুখেই শরৎশশীর মৃত্যু হয়। তিনি রেখে গেলেন এক অত্যুৎজ্বল আদর্শ যাকে কেন্দ্র করে যতীন্দ্রের ইস্পাত কঠিন জীবন গড়ে উঠেছিল। মামারাও ছিলেন মহৎ পুরুষ। তাঁদের কাছেই মানুষ হতে থাকেন যতীন্দ্র ও বিনোদবালা ।


ছোটবেলাতে যতীন্দ্র ছিলেন যেমন দুঃসাহসী তেমনই স্বাধীনচেতা। তাঁদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত গোরাই নদী বা গোরুই নদী। শ্রী চৈতন্য লীলা সাক্ষী এই পদ্মা নদীর শাখাটির নাম মহাপ্রভুর (গোরা রায় ) নামে। বর্ষাকালে ফুলে ফেঁপে ভয়ঙ্কর গোরাই অজস্র বার সাঁতরে পার হয়েছেন বালক যতীন্দ্র। তাঁর মামা অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায় শিখিয়েছিলেন ঘোড়ায় চড়তে এবং নৌকা বাইতে ও বন্দুক চালাতে। যত দিন যেতে লাগলো যতীন্দ্র বড় হতে লাগলেন শুধু বয়সে নয়, আধ্যাত্মিকতা, দুঃসাহস এবং পরোপকারেও। পৌরাণিক ভক্ত চরিত্র, যেমন ধ্রুব, প্রহ্লাদ, হনুমান ইত্যাদির ভূমিকায় অভিনয় করতে ভালোবাসতেন যতীন। গ্রাম্য চারণ কবিদের সাহায্যে যতীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের ভাব গ্রামে প্রচার করতেন। তিনি ভর্তি হলেন কৃষ্ণনগরে ইঙ্গ-ভার্নাকুলার স্কুলে। তিনি শরীরচর্চা করতে ভালোবাসতেন অথচ তাঁর স্কুলে কোনো ব্যায়ামাগার না থাকায় কৃষ্ণনগর কলেজের জিমনাসিয়ামে বালক বয়েসে ভর্তি হওয়ার প্রচেষ্টা করলেন। সেখানে শুধুই সেই কলেজের ছাত্রদের নেওয়া হতো। কিন্তু যতীন্দ্র নাছোড়, তিনি দমে না গিয়ে কলেজের প্রিন্সিপাল বিলি সাহেবের কাছে দরখাস্ত করলেন। বিলি সাহেব তাঁর সাহস ও জিদ দেখে খুশি হয়ে যতীনকে জিমনাসিয়ামে ভর্তি করলেন। জনৈক যদু মল্লের তত্বাবধানে যতীন্দ্র শীঘ্রই পালোয়ান হয়ে উঠলেন। বসন্তমামা তাঁদের বিরাট সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ফেরাজ খান বলে একজন North West Frontier Province - এর সৈন্যকে মোতায়েন করেছিলেন। এই সৈন্যটি ছেলেদের শারীরিক কসরৎ শেখাতেন এবং তাদের স্বাধীনচেতা  হতে শিখিয়েছিলেন।


বালক বয়েসে যতীন্দ্র অসমসাহসিক কাজের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। উকিলবাবুর একটি ঘোড়া কোনোভাবে ক্ষেপে গিয়ে সারা শহরে দ্রুত দৌড়োতে থাকে। এর ফলে সেই ছোট শহরের মানুষের প্রাণান্ত উপস্থিত হয়। যতীন্দ্র দোকানে কেনাকাটা করবার সময় দেখেন যে একটি অসহায় ছোট ছেলে ঘোড়াটির সামনে পড়ে সাংঘাতিক বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। যতীন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সিদ্ধান্ত নেন এবং অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিজে ঘোড়াটির ওপরে চড়ে বসেন। এইভাবে তিনি ঘোড়াটিকে থামান এবং সেদিন বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা করেন। তাঁর বিরাট হৃদয়ের আরো পরিচয় পাওয়া যায়। একদিন যখন তিনি নৌকায় গোরাই নদী পার হতে যাচ্ছিলেন তিনি দেখলেন যে এক বৃদ্ধা রমণী এক বিশাল ঘাসের বোঝা নিয়ে কাতর স্বরে তার মাথায় বোঝাটা তুলে দেওয়ার জন্য সবার কাছে আবেদন করছে, কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করছেনা। যতীন তার বোঝা নিজে নিয়ে তাকে তার কুটির অবধি পৌঁছে দিলেন। এইভাবে তিনি সেই বৃদ্ধার কষ্ট লাঘব করলেন। তাকে এক দরিদ্র মুসলমান জেনে, নিজেকে ক্ষুধার্ত বলে এবং তার পরপারে চলে যাওয়া ছেলে হিসেবে পরিচয় দিয়ে তার অন্ন ভাগ করে খেলেন। প্রতি মাসে এসে তিনি সেই দরিদ্র বৃদ্ধাকে কিছু সাহায্য করতেন। প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময়ে যতীন্দ্র এবং তাঁর অনুগামী যুবকের দল সমস্ত প্রসাদ রান্না করতেন। তাঁর মামারা খুব ঘটা করে পুজো করতেন এবং প্রচুর লোক খাওয়াতেন। যতীন্দ্র মানুষের সেবার জন্য একটি স্বেচ্ছা সেবক দলও তৈরী করেছিলেন।


১৮৯৮ এ এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করবার পর যতীন্দ্র ফার্স্ট আর্টসের ছাত্র হিসেবে Calcutta Central college-এ ভর্তি হন। বিনোদবালা এবং যতীন্দ্র তাঁদের এক মামা প্রসিদ্ধ ডাক্তার হেমেন্দ্র কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে বাস করতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে যতীন্দ্র ব্রিটিশ উপনিবেশকারীদের যন্ত্র হিসেবেই দেখতেন। কর্মক্ষেত্রে সুবিধার জন্য প্রথাগত পড়াশুনার বাইরে তিনি টাইপিং শিখতে আরম্ভ করেন। সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে তিনি ডন সোসাইটি তে অনুপ্রেরণামূলক লেকচার শুনতে যান। Atkinson কোম্পানিতে স্টেনোগ্রাফারের পড়াশুনা শেষ করে তিনি Amhuti & company নামক কলকাতার এক সওদাগরী অফিসের কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন। অপরকে সাহায্য করাই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনে নিজের অর্থের সবটাই তিনি তাঁর এক অনুগামীর মুমূর্ষু মায়ের চিকিৎসার জন্য দিয়ে দেন। বস্তুত পক্ষে তাঁর সেই অনুগামী তাঁকে পরীক্ষা করছিলেন। যতীন্দ্রের মহত্বের পরিচয় পেয়ে তিনি অবশ্যই আনন্দিত হন। কলকাতার আবহাওয়ায় যতীন্দ্রের শরীর খারাপ হয়। স্বামী বিবেকানন্দর পরামর্শে তিনি ক্ষেত্রনাথ (গোবর) গুহর আখড়ায় কুস্তি শিখতে আরম্ভ করেন। স্বামীজীর ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি সেখানে শশীদা বা শশীভূষণ রায়চৌধুরী এবং শচীনদা বা শচীন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সঙ্গে দেখা করেন। শচীনদা যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের (বিপ্লবী আন্দোলনের একজন বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক) পুত্র। এই দুই দাদাই তাঁর ওপরে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেন। সম্ভবত সিস্টার নিবেদিতা অথবা স্বামীজীর গুরুভাই সারগাছিতে অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠাতা স্বামী অখণ্ডানন্দজী যতীন্দ্রকে স্বামী বিবেকানন্দের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। রিলিফ বা সেবাযজ্ঞের মাধ্যমেই যতীন্দ্রনাথ এঁদের পরিচিতি লাভ করেন এবং কলকাতার প্লেগ সেবাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেন। স্বামীজী একদৃষ্টে যতীন্দ্রনাথের দিকে চেয়ে কি দেখেছিলেন তা তিনিই জানতেন। হয়তো তিনি সেই প্রচ্ছন্ন আগুনকে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন যা একদিন ইংরেজ সাম্রাজ্য কে লেলিহান শিখার মতো গ্রাস করবার চেষ্টা করবে। মুজাফ্ফরপুরের ব্যারিস্টার Trihoot Courier এর সম্পাদক প্রিঙ্গলে কেনেডি যতীন্দ্রের একজন শুভানুধ্যায়ী হিসেবে তাঁকে সেক্রেটারি পদে নিয়োগ করেন। বিনোদবালার স্মৃতিকথা অনুযায়ী এই সময়টা যতীন্দ্রের জীবনের খুবই উল্লেখযোগ্য সময়। এই সময় তাঁর প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়। ১৯০০ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর যতীন্দ্র মুজাফ্ফরপুর ছেড়ে চলে আসেন। কেনেডির সুপারিশ অনুযায়ী পরে তিনি বাংলার ব্রিটিশ সরকারের I.C.S হেনরি এ. হুইলারের কাছে কর্ম শুরু করেন এবং প্রচুর উন্নতি করেন। হুইলারের বাংলার প্রশাসনের ওপরে বিরাট দখল ছিল। তিনি যতীন্দ্রকে তাঁর কর্মদক্ষতা এবং দেশভক্তির জন্য খুব স্নেহ করতেন। অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জমিদাররা হুইলারের কাছে যেতেন এবং তাঁরাও যতীন্দ্রের ব্যবহারে তাঁর বন্ধু এবং অনুরাগী হয়ে পড়েন।


১৯০০ সালে যতীন্দ্র কুমারখালী কুষ্টিয়ার ইন্দুবালা ব্যানার্জীকে বিয়ে করেন। তাঁদের চার ছেলে মেয়ে হয় - অতীন্দ্র, আশালতা, তেজেন্দ্র, এবং বীরেন্দ্র। অতীন্দ্র স্বল্পায়ু ছিলেন, তিনি ১৯০৬ সালে মারা যান। এই অকাল মৃত্যুর শোকে যতীন্দ্র এবং তাঁর স্ত্রী ভেঙ্গে পড়েন।  তাঁর স্ত্রী এবং দিদি বিনোদবালাকে নিয়ে যতীন্দ্র তীর্থ পর্যটনে হরিদ্বার ও হৃষীকেশ যান। সেখানে তাঁরা ভোলানন্দ গিরির মতো এক অসামান্য সন্ন্যাসীর দেখা পান এবং তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নেন। ভোলানন্দ গিরিজী ছিলেন দয়ানন্দ সরস্বতীর দেশপ্রেমের ভাবে অনুপ্রাণিত। তিনি যতীন্দ্রর মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা আবিষ্কার করে তাঁকে উৎসাহিত করেন। যতীন্দ্রর দিদি বিনোদবালা ছিলেন বালবিধবা। কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ বিদুষী, কবি, এবং যতীন্দ্রর অনুপ্রেরণাদায়িনী। তিনি দেশকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রেরণা দিয়ে যতীন্দ্রের দেশসেবার জন্য পারিবারিক সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, যার ফলে যতীন্দ্র অনেকাংশে নিশ্চিন্ত হয়ে দেশসেবায় অগ্রবর্তী হতে পেরেছিলেন। এই কারণে যতীন্দ্র, যাঁরা তাঁকে সাংসারিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেশের জন্য কাজ করবার সমস্ত রকম সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেই বিনোদবালা এবং ইন্দুবালার কাছে ঋণী ছিলেন। এই কৃতজ্ঞতাবোধ তাঁদের প্রতি যতীন্দ্রের চিঠির প্রতি ছত্রে অনুরণিত।
। শুধু তার জন্য চাই অগাধ দেশপ্রেম, অসীম সাহস ও মনোবল, এবং কঠিন ত্যাগের ব্রত।

“বাঘের সঙ্গে লড়াই করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি”

১৯০৬ সালে যতীন্দ্র যখন তাঁর গ্রামে ফেরেন, তাঁর কানে আসে যে একটি কেঁদো বাঘ (leopard) গ্রামে ঢুকে গ্রামবাসীদের ওপরে অত্যাচার করছে। তিনি সেই বাঘটিকে দেখতে নিজে যান এবং গিয়ে দেখেন যে অমূল্য এবং ফণী, তাঁর মামাতো ভাইয়েরা এয়ারগান নিয়ে বাঘ মারতে গেছে। বাঘটি আসলে ছিল একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এয়ারগানের আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে যতীন্দ্রের ভাইদের ওপরে আক্রমণ করতে যায়। ওস্তাদ কুস্তিগীর হিসেবে যতীনের সুনাম ছিল, ভাইদের বিপদ দেখে তিনি খালি হাতে বাঘটির সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন। খালি হাতে বাঘের সঙ্গে লড়াই-এর জন্য সুনাম ছিল এক প্রখ্যাত বাঙ্গালী শ্যামাকান্ত বন্দোপাধ্যায়ের। যতীন্দ্র বাঙ্গালীর সেই অসাধারণ বীরত্বের ঐতিহ্য বজায় রেখে শুধুমাত্র একটি ছোরার সাহায্যে বাঘটিকে ঘায়েল করলেন। বাঘটির ভয়ানক আক্রমণে তিনি সাংঘাতিক আহত হন। প্রখ্যাত ডাক্তার সুরেশ সর্বাধিকারীর অক্লান্ত চেষ্টায় অবশেষে বেঁচে উঠলেন যতীন। কিন্তু ছ-মাস তাঁকে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী থাকতে হয়। শেষপর্যন্ত তিনি তাঁর হাত এবং পা নড়াবার ক্ষমতা ফিরে পান। যতীনের কাছে থেকে উপহার পাওয়া বাঘের চামড়াটি সুরেশ সর্বাধিকারী যত্ন করে তাঁর ড্রয়িং রুমে রেখে দিয়েছিলেন। ইংরেজিতে তিনি যতীনের ওপর "Nemrod of Bengal" বলে একটি রচনা তৈরী করেন যা পড়ে ব্রিটিশ সরকার যতীন্দ্রের সাহসের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে একটি রুপোর শিল্ড উপহার দেয়। এই ঘটনার পর থেকে যতীন্দ্র "বাঘা যতীন" হিসেবে স্বীকৃতি পান।


বরেণ্য দেশনেতা বিপিন চন্দ্র পাল বাঙ্গালীদের ওপর ইংরেজ গোরা সৈনিক ও অন্যান্য শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ঘুষির বদলে ঘুষির ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গদর্শনের সম্পাদকীয়তে এই প্রতিকারের সমর্থন জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৫ সালের শীতকালে ব্রিটিশ সরকার প্রিন্স অফ ওয়েলস (পরবর্তীকালে পঞ্চম জর্জ) কে বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ বাংলাদেশে পাঠায় যাতে তিনি বাংলার মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে পারেন। ভবিষ্যৎ ইংলণ্ডেশ্বরকে হাতেনাতে ইংরেজ শাসকদের স্বরূপ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যতীন্দ্র হ্যারিসন রোড এবং চিৎপুর রোডের সংযোগ স্থলে অপেক্ষা করে রইলেন। একটি গলির সামনে দিয়ে যে গাড়ি যাচ্ছিলো তার ওপরে গোরা সৈন্যরা পা ঝুলিয়ে বসে ছিল। যে সমস্ত মহিলারা ভবিষ্যৎ ইংলণ্ডেশ্বরকে দেখবার জন্য জানলা দিয়ে উঁকি মারছিলেন, তাদের অসম্মান ও অমর্যাদা করবার প্রতিবাদে যতীন্দ্রনাথ সেই গাড়ির ছাদে উঠে সেইসব গোরাদের প্রহার করেন এবং তারা গাড়ির ওপর থেকে পড়ে যায়। এর ফলে ভীড়ের লোকেরা খুবই খুশি হয়। সেই মহিলাদের আত্মীয়রা যতীনকে ধন্যবাদ দিতে এলে তিনি তাদের এই বলে বকুনি দেন যে তারা তাদের মেয়েদের বাইরে এনেছে অথচ তাদের সম্মান রক্ষার কোনো চেষ্টাই করেনি। যতীন্দ্রের পরিকল্পনা ছিলো হাতে কলমে ইংরেজদের দেখানো যে তাদের অভদ্রতা ও অসভ্যতা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে এবং ভারতবাসীর কাছে তা কতখানি অসহনীয় হয়ে উঠছে। তিনি জানতেন যে সেক্রেটারি অফ স্টেট Morley-র কাছে এ ধরনের অনেক অভিযোগ এলেও তিনি কোনোই ব্যবস্থা নেননি। যতীন্দ্রের পরিকল্পনা সফল হয়। এই ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী প্রিন্স অফ ওয়েলস ইংল্যান্ডে ফেরবার পর ১৯০৬ সালের ১০ মে Morleyকে ডেকে ভারতে ইউরোপিয়ানদের ভারতীয়দের সঙ্গে ব্যবহারের কড়া সমালোচনা করেন।


শুধু এই ঘটনাই নয়। এর পরেও যতীন্দ্র ভারতীয়দের বিরুদ্ধে ইংরেজদের ব্যবহার সম্পর্কে শুধু সরবই হননি, এইসব উৎশৃঙ্খল ও বর্ণবিদ্বেষী গোরাদের যথাযোগ্য শিক্ষা দিতে কসুর করেননি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই সময়টায় ইংরেজের বিরুদ্ধে মুখ খোলা তো দূরের কথা, অধিকাংশ ভারতীয় মুখ বুঁজে সমস্ত অপমান সহ্য করতো। এর ফলে একশ্রেণীর ইংরেজের সাহস স্পর্ধার পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো। লাঠি মেরে কুলিদের প্লীহা ফাটানো থেকে আরম্ভ করে মেয়েদের অপমান ও তাদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করা এবং কালা আদমিদের মানুষ হিসেবে গণ্য না করা ইংরেজ তথা ইউরোপীয়ানদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। যেখানে ভারতীয়রা রুখে দাঁড়াত সেখানে তাদের কপালে জুটতো লাঞ্ছনা ও পুলিশ এবং কোর্টের গঞ্জনা, জেল ও জরিমানা। ইউরোপীয়ানদের বিরুদ্ধে নেটিভদের কোনো অধিকার ছিল না। যতীন্দ্রের মতো কিছু মানুষের দরকার ছিল, যাঁরা ইউরোপীয়ানদের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তাদেরকে এবং ভারতীয়দের শেখাবে কিভাবে দুর্বিনীত ইংরেজদের সোজা করতে হয়। ভারতীয়দের তাদের হীনমন্যতা থেকে জাগানো দরকার ছিল। শুধু ঘুষোঘুষি সন্বন্ধে লেখালেখি করে তাদের জাগানো যাবেনা সেটা যতীন্দ্র ভালোই জানতেন। তাই মারের বদলে পাল্টা মারের এবং তার জন্য জেলে যাওয়ার সাহস অর্জন করবার দরকার।


কিভাবে ইংরেজদের ঢিট করতে হয় তা ভীতু বাঙালিদের যতীন্দ্র আবার হাতে কলমে করে দেখালেন । শিলিগুড়ি স্টেশনে তিন ইউরোপিয়ান মিলিটারি অফিসার কে তিনি মেরে শুইয়ে দিয়েছিলেন। এই ইংরেজদের মধ্যে ছিল Captain Murphy এবং Lt. Sommerville -এর মতো মিলিটারি অফিসাররা। কাজের সূত্রে যতীন্দ্র প্রায়ই গ্রীষ্মকালে দার্জিলিং গিয়ে থাকতেন। শিলিগুড়ি থেকে একবার ট্রেনে ওঠবার সময়ে তিনি দেখেন যে একটি বাচ্চা জল চাইছে। তার বাবা ট্রেন ছেড়ে দেবে বলে নামতে সাহস করছেন না, অতএব যতীন্দ্র জল আনবার দায়িত্ব নেন। জল নিয়ে ফিরে আসবার সময়ে ট্রেন ছেড়ে দেয়। ট্রেনে ওঠবার সময়ে তিনজন ইউরোপিয়ান তাঁকে উঠতে ইচ্ছাকৃত ভাবে বাধা দেয় এবং ঠেলবার চেষ্টা করে। অন্য যেকোনো ভারতীয় এ অপমান হজম করে নিতো কিন্তু যতীন্দ্র অন্য ধাতুতে তৈরী। তাঁর আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ যিনি ইংরেজ রেল কর্মচারীকে অভদ্রতার জন্য তীব্রভাবে তিরস্কার করেছিলেন। যতীন্দ্র সেই ইউরোপীয়ানদের এমন মার দেন যে তারা রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। তারা ছুরি পর্যন্ত বের করেছিল কিন্তু যতীনকে কাবু করতে পারেনি। যতীন তাদের এমন আহত করেন যে তাদের হাসপাতালে যেতে হয়। তারা যতীন্দ্রের বিরুদ্ধে পুলিশ কেস করে। কিন্তু বাঙালির হাতে তিন ইউরোপিয়ান মিলিটারি অফিসারের মার খাওয়া ইউরোপীয়ানদের কাছে লজ্জার ব্যাপার এবং যেকোনো প্রচার বাঙালী যুবকদের এমন ঘটনায় আরো বেশি উৎসাহিত করতে পারে, এই ভয়ে সরকার কেস গুটিয়ে নেয়। হুইলার সমস্ত শুনে যতীন্দ্রকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানান। তিনি যতীন্দ্রকে একদিন জিজ্ঞাসা করেন যে যতীন্দ্র খালি হাতে কজন ইউরোপীয়র মহড়া নিতে পারবে। যতীন উত্তরে বলেন যে সৎ একটিকেও নয়, কিন্তু অসৎ এবং অধার্মিকদের অনেককে একসঙ্গে আক্রমণ করতে তিনি পেছপা হবেননা। এই সাহসিক উত্তর হুইলারকে মুগ্ধ করে এবং তিনি আরো বেশি যতীন্দ্রর গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন। যতীন্দ্র তাঁর মামা বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায় কে টেলিগ্রাম পাঠান, "Three military aggressors substantially taught."
 

“উদয়শিখরে জাগে মা ভৈঃ মা ভৈঃ নবজীবনের আশ্বাসে”

যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, যিনি পরে আধ্যাত্মিক জীবনে আকৃষ্ট হন এবং সন্ন্যাস দীক্ষা নিয়ে নিরালম্ব স্বামী নাম গ্রহণ করেন, বরোদা থেকে অরবিন্দ ঘোষ দ্বারা প্রেরিত হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা নিয়ে বাংলায় আসেন। এই দুই যতীন্দ্রের মধ্যে পার্থক্য করবার জন্য যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে বাঘা যতীন হিসেবেই আলোচ্য প্রসঙ্গে উপস্থাপনা করা হবে। ব্যারিস্টার প্রমথ মিত্র ব্রিটেন থেকে ফিরে অনুশীলন সমিতি নামে একটি গুপ্ত সংস্থা স্থাপন করেন যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিকে প্রকাশ্যে শরীর চর্চায় উৎসাহিত করে গোপনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা। ১৯০৩ সালে অরবিন্দ ঘোষ বাংলায় এসে বিদ্যাভূষণের আশ্রয় গ্রহণ করেন। যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণ ছিলেন রাষ্ট্রবিপ্লবের ওপরে একজন জনপ্রিয় লেখক। তাঁর লেখা Mazzini-র ও Garibaldi-র জীবনী তরুণদের খুবই অনুপ্রাণিত করে। বাঘা যতীনের এক মামা ললিতকুমার বিবাহ করেন বিদ্যাভূষণের মেয়েকে। সুতরাং তাঁদের মধ্যে যে আত্মীয়তার সূত্র ছিল তা দুজনের অনাবিল দেশপ্রেমের মধ্য দিয়ে দৃঢ় হয়েছিল। অম্বু গুহর আখড়ার শচীনদা ছিলেন বিদ্যাভূষণেরই এক সন্তান। অরবিন্দ এবং বাঘা যতীনের মধ্যে মিলন প্রথম সংগঠিত হয় বিদ্যাভূষণের গৃহে। ভবিষ্যৎ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ এই সাক্ষাৎকারের মধ্যেই বপন হয়েছিল। অরবিন্দর মধ্যে বাঘা যতীন দেখেছিলেন ভারতের এক এবং অদ্বিতীয় অবিসংবাদী মহামানব নেতা কে। অন্যদিকে বাঘা যতীনকে অরবিন্দ পেয়েছিলেন এক বিশ্বাসী সহযোগী হিসেবে। এঁদের মধ্যে যোগাযোগ তাই রামচন্দ্র ও হনুমান, বা অর্জুন ও কৃষ্ণের প্রথম মিলনের মতোই অনন্ত সম্ভাবনার দ্যোতক।


১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বাংলা তেতে ওঠে। বিভাজনের রাজনীতিকে ধিক্কার জানিয়ে জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলি অগ্নিবর্ষণ করতে থাকে, যার পুরোভাগে ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এবং তাঁর সন্ধ্যা পত্রিকা। সতীশ চন্দ্রের Dawn Society যুবসমাজকে গীতার আদর্শে শিক্ষা ও চরিত্র গঠনে উৎসাহিত করেছিল। এ বিষয়ে পথিকৃত স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শকে সামনে রেখে সিস্টার নিবেদিতা একদিকে যুবসমাজকে স্বামীজীর কাজে ও দেশের কাজে আত্মনিবেদন করতে অনুপ্রাণিত করেন। অপরদিকে তিনি বিখ্যাত দেশনেতাদের যথাসম্ভব সাহায্য করতে থাকেন। তাঁর মনীষা ও প্রজ্ঞা ইংরেজ রাজসরকারের পক্ষে এক বড়ো বাধার সৃষ্টি করে। ১৯১০ সালে তাঁর অকাল মৃত্যু সমগ্র দেশপ্রেমিকদের পক্ষে বিরাট ক্ষতির সৃষ্টি করে। বাঘা যতীনের ও অরবিন্দর সঙ্গে নিবেদিতার যোগাযোগ ছিল। লালা লাজপত রাই, বালগঙ্গাধর তিলক ও বিপিন পাল কংগ্রেসের আবেদন নিবেদন মূলক ভিক্ষার রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাবার ডাক দেন। যুগান্তর পত্রিকা বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহমূলক লেখা লিখতে থাকে। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং পরে অরবিন্দের ছোটভাই বারীন্দ্র কুমার ঘোষ। পত্রিকার অন্তরালে ছিল বিপ্লবী সংস্থা যুগান্তর যার অন্যতম সর্বাধিনায়ক ছিলেন বাঘা যতীন। যুগান্তর হেমচন্দ্র কানুনগো, তারকনাথ দাস প্রমুখকে বিদেশে পাঠায় বোমা তৈরী শেখবার জন্য। ১৯০৮ সালে সংঘঠিত হয় প্রখ্যাত আলিপুর বোমার মামলা যাতে ধরা পড়েন অরবিন্দ, বারীন্দ্র, উল্লাসকর সহ ত্রিশের অধিক বিপ্লবী। এর মুলে ছিল ক্ষুদিরাম বোস এবং প্রফুল্ল চাকীর মুজাফ্ফরপুরের ম্যাজিস্ট্রেট অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যা করবার প্রচেষ্টা। দুর্ভাগ্যক্রমে ক্ষুদিরামের ছোড়া বোমার আঘাতে মারা যান ব্যারিস্টার প্রিঙ্গলে কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন ও তাঁর ফাঁসি হয়। প্রফুল্ল চাকী ইন্সপেক্টর নন্দলালের নেতৃত্বে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আত্মহত্যা করেন। নন্দলাল মৃত প্রফুল্লর মাথা কেটে কলকাতায় পাঠায়। বিপ্লবীরা নন্দলালকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিশোধ নেন। বিচার চলাকালীন রাজসাক্ষী হতে স্বীকৃত হন নরেন্দ্রনাথ গোসাঁই। জেলের হাসপাতালের মধ্যে তাঁকে হত্যা করেন কানাইলাল দত্ত আর সত্যেন বোস। দুজনেই ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন। বিচারে বারীন্দ্র সমেত বেশীরভাগ বিপ্লবীর দ্বীপান্তর হয়। এই বিচার চলাকালীন অরবিন্দর আইনজীবী হিসেবে দাঁড়ান চিত্তরঞ্জন দাস এবং তাঁর অনন্য সাধারণ প্রচেষ্টায় বিচারপতি নর্টন অরবিন্দকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। জেলের মধ্যে ঈশ্বর দর্শনকারী শ্রী অরবিন্দ এই মামলার পর নিজেকে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে পন্ডিচেরি চলে যান এবং সেখানে যোগসাধনায় বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। এর ফলে বাংলার বিপ্লবী সমাজে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সেই দুঃসময়ে শক্ত হাতে হাল ধরেন বাঘা যতীন। তিনি বিপ্লবী সংস্থাগুলির বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralization) করেন। এরফলে যদিও সংযোগ রক্ষার কাজ বেড়ে যায়, পুলিশের পক্ষে সংস্থাগুলিকে আবিষ্কার করা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। একটি ধরা পড়লে অপরগুলি তাদের কাজ ঠিক চালিয়ে যেতে পারতো। ১৯০৫ সাল থেকে তিনি এই কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে তিনি ছাত্র ভান্ডার তৈরী করেন যার বাইরের রূপ ছিল স্বদেশী পণ্য বিক্রয় করা এবং ভেতরে ভেতরে ছাত্র যুবকদের বিপ্লবের কাজে যোগদান করানো ও ট্রেনিং দেওয়া। বাঘা যতীন ছিলেন একজন অসাধারণ পরিকল্পক বা Planner । তিনি বেশ কিছু তরুণ বিপ্লবীকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের বড়ো কাজের জন্য তৈরী করেন। বাংলার প্রশাসনকে বিকল করবার কাজে তিনি তাদের নিয়োগ করেন। বারীন্দ্রর সঙ্গে মিলে তিনি দেওঘরে বোমা তৈরির কারখানা বানান। কিন্তু যে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ অনেক সময়ে নিরীহ এবং নির্দোষ মানুষকেও বিপদে ফেলে, যতীন তার বিরোধী ছিলেন। বিপ্লব কার্য্যের জন্য অর্থের প্রয়োজনে স্বদেশী ডাকাতিতে তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হয়েছিলেন এই শর্তে যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের মানুষের কাছ থেকে লুণ্ঠন হওয়া টাকা তাঁদের ফেরত দিতে হবে এবং এই টাকা বর্তমানে তাঁদের কাছে ধার হিসাবে নেওয়া হবে। অরবিন্দ এবং বারীন্দ্রর অনুপস্থিতিতে বাঘা যতীন বিপ্লবী সংস্থার নেতা হলেও তাঁকে পুলিশ প্রমাণাভাবে ধরতে পারেনি, এমনই ছিল তাঁর কাজের ধারা এবং বুদ্ধিমত্তা।
 

“পতন অভ্যূদয় বন্ধুর পন্থা যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী”

ইংরেজ পুলিশ জানতো অরবিন্দ বারীনের গ্রেফ্তারে বাংলার বিপ্লব শেষ হয়ে যায়নি। তাই তারা collaborator বা সাহায্যকারীদের সাহায্যে বাকি বিপ্লবীদের সন্ধানে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছিল। এই সাহায্যকারীদের মধ্যে সবথেকে কুখ্যাত ছিল শামসুল আলম নামের একজন পুলিশ গোয়েন্দা অফিসার। বাঘা যতীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী শামসুল আলমকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করেন বীরেন্দ্র দত্তগুপ্ত। এছাড়াও public prosecutor আশুতোষ বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করেন চারুচন্দ্র বোস। শামসুল আলম হত্যায় হাওড়া-শিবপুর চক্রান্ত মামলায় ধরা পড়েন বাঘা যতীন। পুলিশের চক্রান্তে বীরেন্দ্র যতীনের নাম করে ফেলে। এর ফলে যতীন্দ্রকে গ্রেফ্তার করতে পুলিশের সুবিধা হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারী ভারত ছাড়ার আগে ভাইসরয় মিন্টো বলেন যে এক নতুন অরাজকতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভারতের ব্রিটিশ রাজকে নানাভাবে অসুবিধেয় ফেলা হচ্ছে। তিনি যতীন্দ্রকে বিপ্লবীদের নেতা হিসেবে প্রকারান্তরে ঘোষনা করেন। বাঘা যতীনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবের বীজ বপণ করে তাদের দিয়ে ইংরেজ রাজত্বের উৎখাত করানো। এই কাজে তিনি সাহায্য নিয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামসের ১০ নম্বর জাঠ রেজিমেন্টের। ১৯০৬ সাল থেকে তিনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। ১৯১০ সালে গোয়েন্দা পুলিশ এই রেজিমেন্টের পরিকল্পনা ধরে ফেলে এবং হাওড়া-শিবপুর মামলা চলাকালীন সরকার তাদের সাতজন অফিসারকে কোর্ট মার্শাল করে এই বাহিনীটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। লর্ড হার্ডিঞ্জ নতুন ভাইসরয় হয়ে আসবার পরে যতীন্দ্রকে সমস্ত ষড়যন্ত্রের মূল হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলার অরাজক অবস্থার কথা স্বীকার করেন। এই পরিস্থিতিতে হার্ডিঞ্জ ১৯১১ সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করবার ব্যবস্থা করেন। এই সূত্রে আবির্ভাব হয় আরেক মহাবিপ্লবীর যাঁর নাম রাসবিহারী বসু। 


১৯১০ সালের সাতাশে জানুয়ারী যতীন্দ্রকে তাঁর দুই মামাদের সঙ্গে গ্রেফতার করে চার্লস টেগার্ট। এর মূলে ছিল বীরেন্দ্রর ভুল বোঝাবুঝি এবং আরো কিছু লোকের সাক্ষ্য। অন্ততঃ পঞ্চাশ জন বিপ্লবীকে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। হার্ডিঞ্জের সরকারের রিপোর্টে বলা হয় যে গোয়েন্দা পুলিশ এতজনকে গ্রেফতার না করে শুধু একজন ধুরন্ধর পরিকল্পনাকারি মস্তিস্ককে শাস্তি দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করলে পারতো। একটি অভিযোগের মধ্যে ছিলো ১০ নম্বর জাঠ রেজিমেন্টের সঙ্গে যতীন্দ্রের যোগসাজশ এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু এ বিষয়ে পুলিশ কোনো প্রমাণই সংগ্রহ করতে পারেনি। বাঘা যতীন যেহেতু দলগুলির বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তাঁদের কাজকর্ম একে অপরের থেকে গোপন রেখেছিলেন, তাঁর ভূমিকা সম্বন্ধে পুলিশ কোনো তথ্যই বার করতে পারেনি। বিচারপতি নর্টনের এজলাসে ১৯১১ সালে তিনি একবছর কারাবাসের পর প্রমাণাভাবে ছাড়া পান, কিন্তু তাঁর সরকারি চাকরিটি যায়। জেলের মধ্যে থাকাকালীন যতীন বিভিন্ন জাতের কয়েদিদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা আনেন।  


জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। পালিয়ে গিয়ে তিনি ঝিনাইদহ থেকে সরকারের ঠিকাদারীর কাজ করতে থাকেন। এ কাজে তাঁকে সাইকেল বা ঘোড়ার পিঠে চেপে বাংলার প্রত্যন্ত জেলাগুলিতে যেতে হতো, কিন্তু এতে তাঁর বিপ্লবের কাজের সুবিধা হয়েছিল, কারণ এর মাধ্যমে তিনি বিপ্লবী সংগঠনগুলিকে আবার তৈরী করতে থাকেন। এই সময়ে তাঁকে অত্যন্ত সাবধানে চলতে হয় কারণ পুলিশ তাঁর গতিবিধির ওপরে কড়া নজর রাখছিলো। বাঘা যতীন ছিলেন বেপরোয়া, কঠোর পরিশ্রমী, অসম্ভব বুদ্ধিমান, এবং যেকোনো কষ্ট সহ্য করতে পটু। তাই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি বিপ্লবীদের বড়ো কাজের জন্য তৈরী করতে থাকেন। তাঁর স্বভাব ছিল মিশুকে। সবাইকে তিনি আপন করে নিতে পারতেন। এর ফলে অনেক বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। বিপ্লবীদের ওপরে তাঁর এতটাই দখল ছিল যে তিনি যখন পুলিশের নজরবন্দী ছিলেন, সেই সময়ে কোনো বিপ্লবী কর্ম ঘটানো হয়নি, পাছে তা বাঘা যতীনের ওপরে সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
 

bottom of page