top of page

Bagha Jatin (Bangla Version)

The Bengali version is a translation of the English version with guidance and input from Sri Prithwindra Mukherjee, Padmashree, grandson of Bagha Jatin, a great and worthy scholar in French and English, who has written several works, including Life and Times of Bagha Jatin, and has contributed immensely toward Info-French cultural bonding.  We express our deep reverance and gratitude to the great scholar for his help, active and untiring support, and endeavour for bringing to light the immense contribution of Bagha Jatin to the Indian freedom movement. 

   বাঘা যতীন - ভারতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় 
-শান্তনু দে ও পৃথ্বী
ন্দ্রনাথ মুখার্জী
 
Chapter 5

“প্রভাত সূর্য এসেছো রুদ্র সাজে দুঃখের পথে তোমারি তূর্য বাজে”

ফেব্রুয়ারী বিদ্রোহ দমন করা হলেও বাংলায় কিন্তু যতীনের নেতৃত্বে যুগান্তর দলের বিদ্রোহের পরিকল্পনা চলতে থাকে। ১৯১৫ সালের মার্চ মাসে থাইল্যান্ড এবং বর্মার দুজন জার্মান দূত এমিল এবং থিওডোর হেলফেরিচ - জার্মান অর্থমন্ত্রী কার্ল হেলফেরিচের ভাই, বাঘা যতীনের সহযোগী জিতেন লাহিড়ীর মাধ্যমে যুগান্তর দলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। যতীন নরেন ভট্টাচার্য কে বাটাভিয়া, ভোলানাথ চ্যাটার্জী কে ব্যাঙ্কক এবং অবনী মুখার্জীকে জাপান পাঠান। বার্লিন কমিটির দূত হিসেবে চট্ট ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জার্মান কাইজারের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। জার্মানির সঙ্গে চুক্তি হয় যে ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়াতে জার্মান সাম্রাজ্য সর্বপ্রকার সাহায্য করবে। এক মাসের মধ্যেই নারায়ণ এস মারাঠে এবং ধীরেন সরকার (প্রফেসর বিনয় সরকারের ভাই) কাইজারের থেকে অনুমতিপত্র এবং নির্দেশ নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসি তে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর, জার্মানির মিলিটারি অধ্যক্ষ ভন পাপেন জার্মান রাষ্ট্রদূত Bernstorffকে অস্ত্র কেনবার ব্যাপারে জানান। প্রায় এগারো হাজার রাইফেল, চল্লিশ লক্ষ কার্তুজ, আড়াইশো মাউসার পিস্তল, এবং পাঁচশো রিভলভর, সঙ্গে গুলি - এই পরিমানে অস্ত্র কেনা হয়েছিল বাঘা যতীনের রাষ্ট্রবিপ্লবে সাহায্যের জন্য। ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে নরেন ভট্টাচার্য হেলফেরিচদের সঙ্গে দেখা করেন এবং মাভেরিকের অস্ত্র নিয়ে আসার সংবাদ শোনেন। যতীনের নির্দেশ অনুযায়ী বিপ্লবীদের একটি দল সেই সব অস্ত্রগুলি বাংলার এবং ওড়িষ্যার উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করবার প্রস্তুতি নেয়। ১৯১৫ বড়দিনের দিন অভ্যুত্থানের স্থির হয়েছিল। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছিল Christmas Day Plot। যতীন ১৪ নম্বর রাজপুত রেজিমেন্টে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাংলা থেকে মাদ্রাজের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা কেটে দেওয়া এবং কলকাতার দখল নেওয়ার দুঃসাহসিক প্ল্যান তৈরী হয়েছিল। যুগান্তর দল এই বিদ্রোহের পরিকল্পনাকে সফল করবার জন্য হেলফেরিচ ভাইদের থেকে প্রায় ৩৩০০০/- টাঃ পেয়েছিলো। এই টাকা এসেছিলো এক জাল সংস্থার মাধ্যমে, যাতে পুলিশ কোন ভাবেই এই টাকার হদিশ না পায়। কিন্তু এই সময়ই বাটাভিয়ার ব্রিটিশ দূতের কাছে একজন বিশ্বাসঘাতকের দ্বারা যুগান্তর এবং মাভেরিক সংক্রান্ত সমস্ত খবর চলে আসে। সমগ্র এশিয়া ব্যাপী এই পরিকল্পনা মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহ থেকে শুরু করে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বন্দী মুক্তির মাধ্যমে এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলো। যতীনের অনুগামী হরিকুমার চক্রবর্তী কলকাতাতে হ্যারি এন্ড সন্স নাম কোম্পানি খোলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কিছু মেধাবী ছাত্রের সাহায্যে এই কোম্পানিকে কেন্দ্র করে জার্মানির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। মাভেরিককে বালেশ্বর পাঠানোর ব্যবস্থা করে নরেন ভট্টাচার্য ফিরে আসেন। তাঁর তথ্য অনুযায়ী এই স্টিমারে প্রায় ৩০,০০০ বন্দুক, গুলি, এবং প্রচুর টাকা থাকবার কথা। সমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবার দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রত্যেকের ওপরে অর্পণ করা হলো। এই অস্ত্র পাওয়ার পরে যুদ্ধ শুরু করে ফোর্ট উইলিয়াম দখল করবার আয়োজন করা হলো। কলকাতাতে পুলিশের শ্যেনচক্ষু এড়াতে যতীন বালেশ্বর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। 

“তোমার পতাকা যারে দাও তারে  দাও বহিবার শকতি”

যতীন অনুধাবন করতে পারছিলেন যে তাঁর চারদিকে জাল ঘনিয়ে আসছিলো। মাভেরিক জাভাতে একটি ওলন্দাজ জাহাজের কাছে এবং অ্যানি লারসেন ও এস এস হেনরী আমেরিকার কাছে ধরা পড়ে। বার্লিন কমিটির হেরম্ব গুপ্ত এস এস লারসেনে ছিলেন। তিনি ধরা পড়েন এবং শিকাগোতে শ্বেতাঙ্গ জুরির বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন। সমস্ত খবর পেয়ে যাওয়ার দরুন কলকাতা পুলিশ হ্যারি এন্ড সন্স কোম্পানিতে তল্লাশি চালায়। জাপান থেকে রাসবিহারী নিয়েলসন জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র পাঠাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু সাংহাইতে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হয়। তিনি পুনে জেলে আত্মহত্যা করেন। নরেন ভট্টাচার্য  আমেরিকা পালান এবং সেখানে মানবেন্দ্রনাথ রায় ছদ্মনাম নেন। এই ভাবে ইউরোপীয় ফ্রান্স-হল্যান্ড-ব্রিটেন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান ও চীনের সম্মিলিত শক্তির কাছে একটি অত্যন্ত বিশাল, ব্যাপক পৃথিবীব্যাপী বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই শেষ নয়। আজও ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় সেই অসাধারণ মানুষটির পরিকল্পনা শক্তির এবং তাকে রূপায়ণ দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতার কথা।  সত্যিকারের নেতা তিনি। বাঘা যতীন নিদারুণ বিপদের সময়েও তাঁর সঙ্গীদের ছেড়ে নিজেকে বাঁচাবার কথা ভাবেননি। তিনি শুধুমাত্র নিজের এবং সঙ্গীসাথীদের বলবুদ্ধির ওপরে ভরসা করে এক প্রচন্ড ক্ষমতাশালী বিশ্বব্যাপী শক্তির সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। একথা সত্যি যে তাঁকে অস্ত্রের জন্য বিদেশী শক্তির ওপরে নির্ভর করতে হয়েছিল, যা তিনি হেরে যাওয়ার প্রধান কারণ বলেছিলেন। কিন্তু যেকোনো মুক্তি আন্দোলনেই বিদেশী শক্তির সাহায্য নিতে হয়েছে। আন্দোলন সফল করতে লাগে অস্ত্রশস্ত্র, লাগে টাকাপয়সা, যা বাংলার তথা ভারতের বিপ্লবীদের কাছে ছিলনা। তাঁদের সম্বল ছিল শুধুই অদম্য সাহস আর স্বাধীনতার জন্য উদগ্র বাসনা । হয়তো তাঁদের মধ্যে সবাই সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ছিলেন না। কিন্তু তাতে তাঁদের আত্মবলিদান ও ত্যাগের মাহাত্ম বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন হয়না। যতীন দেখিয়েছিলেন যে শুধুমাত্র ঈশ্বরের ওপরে নির্ভর করে এক বিরাট কর্মের সূচনা করা যায়। তাঁর এই কর্ম সফল হলে বিশ্বব্যাপী ইতিহাসের মোড় পাল্টে যেত। কিন্তু তা না হওয়াতেও তিনি হতাশ হননি।


পরিতাপের বিষয় এই যে যতীনকে কেউই আশ্রয় দিতে স্বীকৃত হলেন না। এমনকি বন্ধুস্থানীয় বর্ধমানের মহারাজা পর্যন্ত তাঁকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করলেন। হাওড়ার একজন যুগান্তর নেতা অতুলচন্দ্র সেন ছিলেন বাগনান হাই স্কুলের শিক্ষক। যতীন তাঁর কাছে গিয়ে কিছুদিন রইলেন। অতুল তাঁর এক অত্যন্ত বিশ্বস্ত প্রতিবেশী চন্দ্র সামুইয়ের কুঁড়ে ঘরে যতীনকে রাখবার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর আশ্রয়দাতার সারল্যে ও সাহসে মুগ্ধ যতীন যখন চন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন যে তিনি কি জানেন কাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন এবং তার পরিনাম কি হতে পারে, নির্ভীক চন্দ্র উত্তর দেন যে ফাঁসি গেলেও এই সৎ কার্য্যের জন্য তিনি স্বর্গে যাবেন, অতএব তিনি ভয় পান না। বাগনান হাই স্কুল রথতলার মাঠে দুলে পাড়ার পাশে অবস্থিত। যতীন এখানে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। একদিন স্থানীয় পুলিশ তাদের ইউরোপীয় কর্তাদের সঙ্গে সেখানে পরিদর্শনে যায়। অতুলবাবু ভয় পেয়েছিলেন কারণ সেখানে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ছড়ানো ছিল, যদিও যতীন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ভয় পেলেও হেডমাস্টার মহাশয় উপস্থিত বুদ্ধি হারাননি। তিনি অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা করলেন এবং চেয়ার পেতে তাঁদের বসালেন। সেই স্কুলের বাগানের কর্মচারী অতিথিদের জন্য জল আনবার ছল করে নিজে থেকেই এক কলসি নিয়ে স্কুলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে আবার বেরিয়ে এলেন। তিনি জল নিয়ে এলেন। পুলিশ স্কুলে ঢুকে তল্লাশি চালিয়েও কিছুই পেলোনা। সেই কর্মচারীটি তাঁর কলসির মধ্যে সমস্ত অস্ত্র লুকিয়ে নিয়েছিলেন, যদিও তাঁর হেডমাস্টার তাঁকে কিছু জানাননি। কর্মচারীটি বুঝতে পেরেছিলেন যে স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবীরা নিজেদের উৎসর্গ করছেন। এই আত্মত্যাগ তাঁকে সেদিন সাহায্য করবার প্রেরণা দিয়েছিলো।

“সেদিন কঠিন রণে, দংশন ক্ষত শ্যেন বিহঙ্গ যুঝে ভুজঙ্গ সনে”

বাগনান থেকে যতীনরা ট্রেন ধরেন। ট্রেনে এক ইউরোপীয় ভারতীয়দের ওপরে অযথা গালিগালাজ বর্ষণ করে। যতীনের সঙ্গীরা উত্তজিত হয়ে পড়লেও যতীন অপূর্ব আত্মসংযম দেখিয়ে নিজেকে এবং তাঁদের শান্ত করেন। বড়ো কাজে যে জন্য যাচ্ছেন সেটা যাতে কোনোমতেই পন্ড না হয় সে দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। তিনি কিছু সময় কাঁথি এবং তমলুকে কাটান। তারপরে তিনি পায়ে হেঁটে বালেশ্বর গিয়ে সেখানকার জঙ্গলপূর্ণ একটি গ্রামে থাকতে শুরু করেন। কাপ্তিপোদার কাছে অবস্থিত সেই গ্রামটির নাম ছিল মহুলডিহা। যে ছ-মাস তিনি ছিলেন, স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে মনীন্দ্র চক্রবর্তী তাঁকে এবং তাঁর সহযোগীদের সর্বতোভাবে সেবা করেন। মনীন্দ্র এই বিপদসংকুল মিশন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবে অবহিত ছিলেন। হ্যারি এন্ড সন্স এ তল্লাশির পর পুলিশ তাঁদের অবস্থিতি জানতে পেরে যায়। যতীন চেষ্টা করেছিলেন পাহাড়ী অঞ্চলগুলির দিকে সরে যেতে কিন্তু জ্যোতিষ পাল অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ফেলে তিনি চলে যেতে পারেননি। কাজেই বিপ্লবীদের ধরবার জন্য পুলিশ প্রচুর সময় পায়। নীরেন এবং জ্যোতিষকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য যতীনের সিদ্ধান্ত তাঁদের দেরি করিয়ে দেয়। হ্যারি এন্ড সন্স এর জনৈক কর্মচারীর কাছ থেকে খবর পেয়ে ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল ডেনহাম সাহেব এবং তাঁর সঙ্গে টেগার্ট আর বার্ড কাপ্তিপোদাতে আসেন। বিপ্লবীরা অন্য একটি গ্রামে চলে যাওয়াতে তাদের সঙ্গে সঙ্গে ধরা সম্ভব হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি বিশাল বাহিনী নিয়ে এসে বালেশ্বর এবং সমস্ত রেল স্টেশন ঘিরে ফেলেন যাতে বিপ্লবীরা পালাতে না পারেন। চাঁদবালি থেকে সার্জন্ট রাদরফোর্ডের নেতৃত্বে এক সুবিশাল মিলিটারি বাহিনীও বিপ্লবীদের ধরতে আসে। যতীন এবং তাঁর সঙ্গীরা বৃষ্টি মাথায় করে ময়ূরভঞ্জের পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দুদিন ক্রমাগত হাঁটবার পর বালেশ্বর স্টেশনে এসে পৌঁছন। তাঁরা এই দুদিন বিনা আহার, নিদ্রা এবং জলাভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। চিত্তপ্রিয় এবং অন্যান্য সহযোগীরা কোনো আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য যতীনকে অনুরোধ করেন। কিন্তু যতীন তা কানেই তুললেন না। তিনি জানতেন যে শেষমুহূর্ত এসে গেছে।  একমাত্র সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে মৃত্যবরণ করে তাঁরা এক মৃতপ্রায় জাতিকে জাগাতে পারবেন যে জাতির লোকেরা ইংরেজদের সঙ্গে মিলে তাঁদের ধরিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেনা। শুধু আত্মত্যাগের মাধ্যমেই এই আত্মবিস্মৃত জাতিকে জাগানো সম্ভব। পুলিশ সহজ সরল গ্রাম্য লোকেদের বুঝিয়েছিল যে বন্দুক হাতে একদল দুর্ধর্ষ ডাকাতের সন্ধান তারা করছে এবং তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে প্রচুর পুরস্কার জুটবে। পুরস্কারের লোভে বিপ্লবীদের পিছু নেওয়া এক গ্রামবাসী রাজু মহান্তি দুর্ভাগ্যক্রমে সাবধান করবার জন্য ছোঁড়া গুলিতে মারা যায়। পুলিশ বিপ্লবীদের হদিস পেয়ে যায় এবং তাঁদের ঘিরে ফেলবার আয়োজন করে। বৃষ্টি মাথায় করে জলার ওপর দিয়ে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত ছুটে শ্রান্ত বিপ্লবীরা অবশেষে ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চাষাখণ্ডের কাছে একটি ছোট টিলার নিচে এক বড়ো গর্তের মধ্যে আশ্রয় নেন। বুড়ি বালাম নদীর তীরে তাঁদের অবস্থিতি পুলিশ শীঘ্রই জানতে পারে এবং এক বিরাট বাহিনী সেখানে চলে এসে তাঁদের ঘিরে ফেলে। শ্রান্ত ক্লান্ত অনাহারে মৃতপ্রায় বিপ্লবীরা তাঁদের বীরত্ব ত্যাগ করেননি। পাঁচজন তাঁদের মাউসার পিস্তলের সাহায্যে যুদ্ধ আরম্ভ করেন। সরকার পক্ষে বহু হতাহত হয়। কিন্তু বিপ্লবীরা দেশের সৈন্যদের ওপরে গুলি না চালানোর জন্য সরকার পক্ষ সুবিধে পায়। তারা দেশীয় সৈন্যদের এগিয়ে দেয় এবং সাদা চামড়ার সৈন্যদের পেছনে রাখে। যুদ্ধ চলাকালীন আরো দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হন বিপ্লবীরা। তাঁদের কার্তুজ ফুরিয়ে গেলেও কার্তুজ ভর্তি ব্যাগের চাবি খোলা গেলনা। প্রথমে পড়লেন চিত্তপ্রিয়। প্রিয় দাদার কোলে মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন চিত্তপ্রিয়। ততক্ষনে পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত যতীন। গুলি শেষ নীরেন, মনোরঞ্জনের। যদি সতীর্থদের বাঁচাতে পারেন, এই আশায় আত্মসমর্পণ করলেন যতীন। ম্যাজিস্ট্রেট কিলবিকে সেই অবস্থায় সম্মান জানালেন। ব্রিটিশ পুলিশ কর্তাদের কাছে সমস্ত দায়িত্ব নিজের ওপরে নিয়ে নীরেন, মনোরঞ্জন, ও জ্যোতিষকে শাস্তি না দিতে অনুরোধ জানালেন। “Please see that no injustice is done to these boys, whatever was done, I am fully responsible for that” - এই আবেদনের মাধ্যমে এক চূড়ান্ত মানবিকতাবোধ রেখে গেলেন, যার ন্যায্য সম্মান দিতে ব্রিটিশ অপারগ ছিল। যতীনকে বালেশ্বর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাঁচাবার বহু চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সব চেষ্টা বিফলে দিয়ে তিনি যুদ্ধের পরেরদিন ১০ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করলেন। প্রতিশোধ উন্মত্ত ব্রিটিশ সরকার বিচারের নামে প্রহসন করে নীরেন ও মনোরঞ্জনের ফাঁসির ব্যবস্থা করলো। পরিতাপের বিষয় এই যে সেই দণ্ডাজ্ঞা দিয়েছিলো দুই  ভারতীয় - তার মধ্যে একজন বাঙালী ও অপর একজন ওড়িয়া। জ্যোতিষকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। আন্দামানের সেলুলার জেলে অমানুষিক অত্যাচারে জ্যোতিষ উন্মাদ দশা প্রাপ্ত হন। পরে তাঁকে বহরমপুর জেলে নিয়ে আসা হয় যেখানে তিনি ১৯২৪ সালে মারা যান।

“শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে”

যতীনের মৃত্যুসংবাদ সরকার গোপন রেখেছিলো। তাঁর মৃতদেহ পর্যন্ত পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। সম্ভবত সরকার ভয় পেয়েছিলো যে তাঁর মৃতদেহ কলকাতা আনলে তার পরিণাম বিপজ্জনক হতে পারে। সংবাদ মাধ্যম শুধু জানিয়েছিল পুলিশের গুলিতে পাঁচ ডাকাতের মৃত্যুর কথা। টেগার্ট যদিও যতীনের প্রতি টুপি খুলে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন, কিন্তু নীরেন এবং মনোরঞ্জনকে শাস্তির দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর ভণ্ডামি ধরা পড়ে। 


১৯১৪ সালের বিপ্লব হয়তো অনেক কারণেই ব্যর্থ হয়। বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়াও নেতৃত্বের অভাব, দলাদলি, ব্রিটিশ ও আমেরিকান গুপ্তচর ও গোয়েন্দাদের কৃতিত্ব, অন্য দেশের সাহায্যের ওপরে অত্যধিক ভরসা, নিজের দেশের মানুষের সাহায্য না পাওয়া, সৈন্যবাহিনীর বিশ্বাস অর্জন করতে না পারা ইত্যাদি বহু প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ কারণ হয়তো ছিল, কিন্তু এসবের মধ্যেও যিনি মাথা উঁচু করে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, যিনি মৃত্যুপণ করেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন, হার নিশ্চিত জেনেও, প্রতিনিয়ত ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়েও পিছিয়ে যাননি, এবং সর্বোপরি যিনি এই বিরাট ও ব্যাপক পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তাকে রূপায়িত করতে অনেকটা সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁর প্রতি  কোনো বিশেষণই যথেষ্ট নয়। বাঘা যতীন ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে এক অসামান্য পথিকৃৎ যাঁর মূল্য অপরিসীম। তাঁর দেখিয়ে দেওয়া পন্থা প্রায় পঁচিশ বছর পরে অনুসরণ করেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু এবং একথা অনস্বীকার্য যে সেনা বিদ্রোহই ভারতে স্বাধীনতা আনে। কারণ ব্রিটিশ সরকার আর তাদের ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে, যার ভরসায় তারা দুটি বিশ্বযুদ্ধ লড়েছিল, আস্থা রাখতে পারছিল না। একথা স্বীকার করেছিলেন কমান্ডার ইন চিফ আউকিনলেক, এবং পরবর্তীকালে অস্থায়ী গভর্নর ফণীভূষণ চক্রবর্তী কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্লেমেন্ট এটলী নিজে, যা ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের কাছ থেকে জানা যায়। অহিংস আন্দোলন তথা তার রূপকার গান্ধীজির কতটা ভূমিকা এই ব্রিটিশদের তাড়াতাড়ি করে চলে যাওয়ার নেপথ্যে? এটলীর ঠোঁট কোঁচকানো হাসির সঙ্গে উত্তর, "সামান্যই (Minimal)।" সেনাবাহিনীর মধ্যে এই  বিদ্রোহের প্রথম ও প্রধান কৃতিত্ব যতীনের - তিনিই এর সূচনা করে যান। স্বাধীনতার পর যতীনের সহযোগীরা দাবি রাখেন ফোর্ট উইলিয়ামের নাম পাল্টে যতীনের নামে রাখতে।  কিন্তু স্বাধীনতার ফল ভোগ করা উত্তরসূরীরা সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি। বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান যতীনের অনুরাগী ছিলেন। বাঘা যতীনের পৌত্র পৃথ্বীন্দ্র মুখার্জী, ২০১০ সালে তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী এবং সমসাময়িক কালের ইতিহাস  Bagha Jatin – Life and Times of Jatindranath Mukherjee রচনা করেন। যতীনের ১০০ বছর জন্মোৎসব পালিত হয় বাংলাদেশে অবস্থিত কয়া গ্রামে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মৌলবাদীদের রোষের ভয়ে সেখানকার সরকার তাঁর নামে কোনো স্মারক বসাতে পারেনি। মৌলবাদীরা তাঁর মূর্তি ভেঙে দিয়েছে। তবুও একথা অনস্বীকার্য যে সাধারণ মানুষ তাঁকে ভোলেনি এবং বিভাজনের উর্দ্ধে উঠে তাঁকে সম্মান জানাতে পেরেছে।

পরিশেষে

উপায় এবং উদ্দেশ্যের মধ্যে বিতর্ক আজও চলে আসছে। স্বদেশী আন্দোলনে ব্যবহৃত কিছু উপায়ের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা থাকতেই পারে - যেমন হিংসা বা অর্থের প্রয়োজনে ডাকাতি। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তাঁর ঘরে বাইরে বা চার অধ্যায়ে বিপ্লবীদের প্রতি সম্পূর্ণ সুবিচার করেননি। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য্য যে যতীনের মতো নেতাদের কাছে উপায় বড়ো নয়, উদ্দেশ্যই বড়। যদি উদ্দেশ্য মহৎ ও সাধু হয় মহাভারত এবং গীতার মত অনুযায়ী উপায় কোনো প্রতিবন্ধক নয়। একথা বুঝেছিলেন অরবিন্দ, বুঝেছিলেন যতীন, এবং দেশবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য শিষ্য সুভাষ পরবর্তীকালে পন্থা হিসেবে এর মর্য্যাদা দিয়েছিলেন। অহিংসা নীতির আবরণে তাঁরা দেশবাসীকে মোহাচ্ছন্ন করেননি। এই আদর্শের মূল রূপকার বাঘা যতীন তাই আজও প্রাতঃস্মরণীয় এবং একইভাবে তাঁর আদর্শ একালেও প্রযোজ্য। 

END

bottom of page